October 5, 2025

যেদিন বিভূতিভূষণ ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন পরলোকে …

সোমালিয়া ওয়েব নিউজ: কয়েক দিন আগেই(০ ১। ১ ১। ২ ০ ২ ৪ ) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণ দিবস গেল ,

“সূর্য পশ্চিমে ঢলছে, নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন বিভূতিভূষণ। দাদাকে ফেরাতে ওষুধ-ইনজেকশানে গলদঘর্ম নুটু চেষ্টা করছেন আর হতাশ হচ্ছেন যেন। সন্ধ্যার সঙ্গে

সঙ্গে একটা আশঙ্কার ছায়া দুলতে থাকল গৌরীকুঞ্জের ‘পরে। আচ্ছন্নের মতো পড়ে আছেন বিভূতিভূষণ। নুটু এক দাগ ওষুধ এনে দাঁড়ালো,

দাদা! ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি। ছোট ভাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, কী ওটা? ওষুধ, খেয়ে নাও দাদা।

ওষুধ! থাক নুটু। ক্ষীণকণ্ঠ। টেনে টেনে বললেন, তুই বরং আমার কাছে বোস।

নুটু অবশ্য দু’ পা দূরেও যাচ্ছেন না। কল্যাণী তো আছেনই। কী একটা ওষুধ মালিশ করছেন পেটে। যমুনা এটা-ওটা এগিয়ে দিচ্ছেন। আর তার ফাঁকে বাবলুকে সামলাচ্ছেন ও-ঘরে।

নুটু বসে আছেন বিছানার পাশে। তাঁর দিকে তাকিয়ে বিভূতিভূষণ বললেন, আমরা কত ভাইবোন ছিলেম-না রে। আজ কেবল তুই আর আমি। এর পর তুই একলা। চোখের পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল বিভূতিভূষণের।

দাদা। ধমক দিতে গিয়ে নুটুও কেঁদে ফেলেন। নিজেকে সামলে নিতে পারছেন না তিনি। তবু তিনি ডাক্তার। বুক বাঁধতে চেষ্টা করেন। -আমার কথা রাখবে না দাদা?

নুটুর হাতখানা বুকের পরে টেনে নিলেন বিভূতিভূষণ। ছোট ভাইয়ের হাত!

তবে ওষুধটা খাও।

দে। হাঁ করে ওষুধটা খেলেন। তার পরে করুণভাবে মিনতি, আর আমাকে ওষুধ খেতে বলিসনে ভাই। তুই বরং এক কাজ কর। ঘরে গীতা আছে, তুই পড়, আমি শুনি।

গীতা হাতে নিয়ে নুটু জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ অধ্যায় পড়ব দাদা?

বিশ্বরূপ দর্শন-একাদশ অধ্যায়। -চোখ বুজে আবার যেন ধ্যানমগ্ন হলেন তিনি। নুটু পড়ে চললেন। একে একে ষোড়শ শ্লোক পর্যন্ত পড়ে তাঁর মনে হল, ব্যাখ্যাটাও পড়ে যাই। সপ্তদশ শ্লোক শুরু করলেন-

কিরীটিনং গদিনং চক্রিণঞ্চ, তেজোরাশিং সর্বতো দীপ্তিমন্তম্।
পশ্যামি ত্বাং দুর্নিরীক্ষ্যং সমস্তাদ, দীপ্তানলার্কদ্যুতিমপ্রমেয়ম্ ॥
ত্বমক্ষরং পরমং বেদিতব্যং, ত্বমস্য বিশ্বস্য পরং নিধানম্।
ত্বমব্যয়ঃ শাশ্বতধর্মগোপ্তা, সনাতনস্থং পুরুষো মতো মে ॥

কিরীটিধারী, গদাচক্রহস্ত, সর্বত্র তেজঃপুঞ্জস্বরূপ দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাময় এক অপ্রমেয় পুরুষকে সর্বদিকে অবলোকন করছি।

নুটু বাঙলা বলে যেতেই বিভূতিভূষণ আবার চোখ খুললেন। বললেন, ব্যাখ্যার দরকার নেই। ওতে সময় বেশি যাচ্ছে। তুই শুধু পড়ে যা। নুটু

আবার পড়তে থাকলেন- অনাদিমধ্যান্তমনস্তবীর্যমনস্তবাহুং শশিসূর্যনেত্রম্।
পশ্যামি ত্বাং দীপ্তহুতাশবকত্রং, স্বতেজসা বিশ্বমিদং তপস্তম্ ॥

মর্ত্য থেকে অমর্ত্যলোক বিস্তারী এক জ্যোতির্বলয় যেন রচিত হল সে মন্ত্রে। যেন পরম পথিকের মহাযাত্রার আয়োজন শুরু হয়েছে গৌরীকুঞ্জে। এমন সময় স্বামী প্রজ্ঞানন্দ এলেন। নিমীলিতনেত্র হলেও যেন বুঝতে পারলেন বিভূতিভূষণ। অস্ফুট কণ্ঠে আহ্বান জানালেন স্বামীজিকে। সৌম্যমূর্তি স্বামী প্রজ্ঞানন্দও যেন কিঞ্চিৎ ব্যথাতুর। ওঁর শিয়রে বসে মুখ, ললাট-সমগ্র অবয়ব অবলোকন করলেন।

কী দেখছেন স্বামীজি? কল্যাণী যেন কোন দৈববাণী শুনতে চাইছেন। সে কথার উত্তর দিলেন না স্বামীজি। বোধহয় উত্তর নেই। শুধু বিভূতিভূষণের কানের কাছে মুখ নিলেন, নামগান করি?

গীতার একাদশ অধ্যায় পাঠ শেষ হয়েছে। ওঁর মুখে যেন এক প্রশান্তির ছায়া। মাথা কাত করে সম্মতি জানালেন নামগানে। স্বামীজি শুরু করেন, ‘গুরুব্রহ্মাঃ গুরুবিষ্ণুঃ, গুরুরেব মহেশ্বরঃ।’ গাইলেন রামকৃষ্ণ নামমালা। কীর্তন করে চললেন,

বিভূতিভূষণের প্রিয় ওই জাতীয় সঙ্গীত- ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্’। জপ করলেন রামনাম ‘রামায় রামচন্দ্রায় রামভদ্রায় বেধসে। রঘুনাথায় নাথায় সীতায়াঃ পতয়ে নমঃ।’ তারপর নির্বাণ স্তোত্র- ‘চিদানন্দরূপঃ শিবোহহং শিবোহহম্’ আবৃত্তি। শোনাচ্ছেন কাকে? চৈতন্য লুপ্ত হল কি? নামগান থামিয়ে ওঁর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লেন স্বামীজি। কিন্তু না, এক চৈতন্যলোক থেকে নিত্যচৈতন্যলোকে বিলীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বিভূতিভূষণ সজ্ঞান। তবে যাত্রা বোধহয় শুরু হয়েছে। কথা বললেন, যেন কোন দূরলোক থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর। বললেন, থামলেন কেন স্বামীজি, বলুন, পুণ্যনাম শুনি। এখনও বাকি কত নাম, বুদ্ধ, চৈতন্য, রামপ্রসাদ-কত পুণ্যনাম।

স্বামীজি আবার শুরু করলেন, ও বুদ্ধায় দিবাকরায়, গোতম চন্দিমায়। নুটুর আর সাধ্য নেই কিছু করবার। কল্যাণী যেন পাথর হয়ে যাচ্ছেন।

ঘাটশিলার আকাশে ধীরে ধীরে রাত নেমে এলো। তার আড়ালে এক মহাসর্বনাশ প্রতীক্ষারত গৌরীকুঞ্জের দুয়ারে। সময় বুঝি হয়ে এলো। মুরাতিপুরের আকাশে কান্না ছড়িয়ে যে শিশু যাত্রা শুরু করেছিল একদিন, কত কাল পরে, কত পথ হেঁটে, কত থেমে, কত চলে আজ বুঝি তাঁর বিদায়লগ্ন আসন্ন।

ও কার কান্না এ মুহূর্তে?-তখনও সজ্ঞান তিনি। বললেন বাবলু। বাবলু কাঁদছেকল্যাণী, ওর কাছে যাও।

না। বাবলুকে পরেও পাবেন কল্যাণী। কিন্তু যে পরমনির্ভর চলে যাচ্ছেন, তাঁকে কি আর পাবেন পরে? কাঁদুক বাবলু। কল্যাণী উঠবেন না। সেই শেষ বেলায় কী ভেবে হঠাৎ স্নান করে নিলেন, তারপর একখানা রঙিন লালপেড়ে শাড়ি পরে কপালে বড় করে একটা টিপ দিয়ে, সেই যে কল্যাণী স্বামীর পাশে বসলেন, আর ওঠেননি, উঠবেন না। দুটি চোখে জ্বালিয়ে রাখা অকম্প দীপশিখা। বুঝি শেষ আরতি করছেন আরাধ্যতমের। বাবলুর জন্য উনি নিজ আয়ু দান করেছিলেন, কল্যাণী কি পারেন নিজ আয়ু সমর্পণ করে ওঁকে বাঁচাতে?-আমি সব আমার তুলে দিচ্ছি ঠাকুর। তুমি ওঁকে বাঁচাও। শিয়রে কল্যাণী-মূর্তিমতী প্রার্থনা। তবু সংশয়, তবু কেঁপে ওঠা শঙ্কায়। চোখের জলেই বুঝি নিবে যায় চোখের আলোর প্রজ্বলিত দীপশিখা। তবু যদি দেবতা মুখ তুলে না তাকান, জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকে, সবচেয়ে বড় সর্বনাশকে কি আজ চোখের সামনেই ঘটতে দেখতে হবে? হোক, সে আঘাত তিনি বুক পেতে নেবেন। বুক ভেঙে তাঁর চুরমার করে দিক নির্দয় নিষ্ঠুর সে ভয়ঙ্কর বজ্রবাণ। কাঁদুক বাবলু। ওর সারাজীবনের কান্নাকে কী দিয়ে তিনি ভোলাবেন? কল্যাণী উঠলেন না।

নুটু নিয়ে এলেন বাবলুকে। ঘর ভর্তি তখন লোক। সবাইকে বাবলু চেনে না। অবাক সে। বাবাই কেন চোখ বুজে শুয়ে আছে! মা-কল্যাণী কেন কোলে নিচ্ছে না তাকে। মার চোখে কি জল? কাঁদছে? বললে, কাকিমা, মা-কল্যাণী কাঁদছে, সাট করে দাও। এ কী কাকিমাও কাঁদছে? কী হয়েছে, দাও মুছে দিই।

নুটু বললেন, দাদা, এই যে বাবলু।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে অতি কষ্টে চোখ মেললেন বিভূতিভূষণ। আবার চোখ বুজলেন। ক্ষণিকের অমর্ত্য-আলোকেই হয়তো দেখে নিলেন নিজ জীবনের সমস্ত অধ্যায়কে। ঠোঁটে একটা আশ্চর্য হাসির প্রতিভাস। আস্তে আস্তে চোখের আলো নিবে গেল। জীবনদীপও বুঝি নির্বাপিত।

এ কী হল ঠাকুরপো। হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন কল্যাণী। নুটু দাদার হাতখানা তুলে ধরলেন। আন্দাজ করতে চাইলেন ক্ষীণ জীবনস্রোত তখনও বইছে কিনা। সহসা অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠল রোগশয্যা। আবার,… আবার…. কী এক অলৌকিক কম্পন সমগ্র রোগীদেহে। মনে হচ্ছে, কোন অদৃশ্য হস্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে খাটখানাকে। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর স্তব্ধ সব। সব শেষ। আর্তনাদ করে স্বামীর বুকে আছড়ে পড়লেন কল্যাণী।

পায়ের পরে মুখ থুবড়ে পড়লেন যমুনা কাঁদতে কাঁদতে। জানালার গরাদে মাথা দিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন ছোট ভাই। হায়। বিভূতিভূষণ তখন সকল কান্নার ওপারে।”

ঋণ – “পথের কবি” – কিশলয় ঠাকুর 

Loading