November 30, 2025

আজ নল সংক্রান্তি : কৃষিজীবনের এক লোকাচার

সোমালিয়া ওয়েব নিউজঃ নল সংক্রান্তি বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী দিন, এই উৎসবে ধানক্ষেতে সদ্য গজানো সবুজ ধান গাছকে গর্ভিণী বা গর্ভস্থ নারী হিসেবে পূজা করা হয় এবং লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করা হয়। এটি মূলত ফসল ও ধানের প্রাচুর্য কামনায় কৃষকদের একটি ঐতিহ্যবাহী লোকাচার। 

আশ্বিন মাসের শেষদিন, অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন, বাংলার কৃষিজীবী সমাজে পালিত হয় এক অনন্য প্রথা— নল সংক্রান্তি। প্রকৃত অর্থে এটি কৃষকদের ফসলরক্ষার এক প্রাচীন লোকাচার, যা পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে।

গোঘাটের এক প্রবীণ ব্যক্তি গোবিন্দ সাঁতরা জানান এই সময়টিই ধানের জমিতে ফুল ফোটার ও ফসল আসার সময়। ধানগাছ তখন গর্ভবতী — গাছের ভিতরে যে দুধের মতো নরম অংশটি থাকে, সেটিই পরে ধীরে ধীরে চালে পরিণত হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ৮ মাসে যেমন সাধ ভক্ষণ দেওয়া হয় অনেকে এই প্রথাকে মা লক্ষ্মীর সাধ ভক্ষণও দেওয়া বলেন। কিন্তু এই সময় ধানগাছের সেই দুধ অংশটি নানা পোকামাকড়ের প্রিয় খাদ্য। তারা ধানের রস শুষে নেয়, ফলে ধানের পুষ্টি ব্যাহত হয়, চাল হয় না — সব আগড়া হয়ে যায়। কৃষকের সারা বছরের পরিশ্রম তখন ব্যর্থ হতে বসে।

তখনই ফসল রক্ষার জন্য গ্রামীণ কৃষক সমাজ অবলম্বন করে এক বিশেষ পদ্ধতি — নল পোঁতা। কৃষকরা একে বলেন, “ধানগাছের সাধ ভক্ষণ অনুষ্ঠান” বা নল সংক্রান্তি

আশ্বিন মাস শেষ হওয়ার আগের দিনে গ্রামের পুরুষরা নলগাছ কেটে আনেন। তারপর আশ্বিন মাসের শেষ দিনের সকালে নানা ভেষজ গাছপালা— যেমন নিম, কালমেঘ, তুলসী, ওল, আদা, ভেট, বয়েড়া, মানকচু, চালকুমড়ো খাড়া, নটে খাড়া, কেতকী, বেলপাতা, শশাগাছ,অপরাজিতা, আপাং, মান, ওল, হলুদ, বিছুটি পাতা, কাঁটা নোটে, পেটারি, ধুতরা ফুল, তাল আঁটি, সাদা সরিষা ইত্যাদি— দশ-বারো প্রকারের ভেষজ কুচি করে প্রসাদ প্রস্তুত করেন, তারপর তাতে আতপ চাল, দুধ,পুরীর মহাপ্রসাদ মিশিয়ে নিয়ে ঐ মিশ্রণটিকে বউয়ের কুড়ির পাতা দিয়ে মুড়ে নলগাছেরই পাতা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তারপর পুরোহিত পুজো করেন।

বর্তমানে নলগাছ (যেটি একসময় জলাভূমি এলাকায় সহজলভ্য ছিল) এখন আর তেমনভাবে পাওয়া যায় না। গ্রামীণ পরিসরেও জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, পরিবেশ পরিবর্তন এবং কৃষিজমির রূপান্তরের কারণে নলগাছ প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। তাই নল সংক্রান্তির এই ঐতিহ্যবাহী আচার আজকাল অনেক জায়গায় স্বর গাছ (অন্যত্র একে “স্বরো” বা “সোরা” গাছও বলা হয়) দিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, নলগাছ যেমন ছিল উর্বরতার প্রতীক, তেমনি স্বর গাছও শুভ ও পবিত্র বলে ধরা হয়। তাই মূল ভাব ও আচারগত তাৎপর্য বজায় রেখে মানুষ আজও সেই প্রথা পালন করছেন, যদিও উপকরণে কিছু পরিবর্তন এসেছে।

সংক্রান্তির ভোরে সূর্য ওঠার আগেই সেই মিশ্রণ-বাঁধা নল জমির ঈশান কোণে পুঁতে দেওয়া হতো, উচ্চারণ করা হতো সেই প্রার্থনামূলক ছড়া—

“নল পড়ল ভুঁয়ে,
যা শনি তুই উত্তর মুয়ে।”

এখানে ‘শনি’ অর্থে বোঝানো হয়েছে সব রকম পোকামাকড় বা অশুভ শক্তিকে, যারা ফসলের ক্ষতি করে। কৃষকদের বিশ্বাস, এই নলপোঁতা ও মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ধানক্ষেতের রোগ-পোকার উপদ্রব দূর হয়, ফলন বৃদ্ধি পায়।

লোকমুখে আরও একটি ছড়া প্রচলিত আছে—

অন সরিষা কাঁকুড় নাড়ি,
যা রে পোক ধানকে ছাড়ি।
এতে আছে শুকতা,
ধান ফলবে মুকতা।
এতে আছে কেঁউ,
ধান হবে সাত বেঁউ।
এতে আছে হলদি,
ধান ফলবে জলদি।
এতে আছে ওল,
মহাদেবের ধ্যান করে বল হরিবোল।

এই ছড়াগুলিতে প্রকৃতি, ভেষজ এবং দেবতার প্রতি কৃষকের আস্থা মিলেমিশে আছে। এটি কেবল ফসল রক্ষার উপায় নয়— এটি এক প্রার্থনা, এক বিশ্বাস, এক জীবনদর্শন।

লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই নল পোঁতার মাধ্যমে ক্ষেত ও ফসল অমঙ্গল থেকে রক্ষা পায়, পোকামাকড়ের উপদ্রব দূর হয়, এবং নতুন ধানে সমৃদ্ধি আসে।
গ্রামাঞ্চলের প্রবীণ কৃষকরা বলেন, “নল পুঁতে ক্ষেত রাখলে শস্যে রোগ লাগে না, দেবতার আশীর্বাদে ফলন ভালো হয়।”

ভোরবেলা জমিতে ধূপধুনো দিয়ে শুদ্ধি করা হয়, তারপর চার কোণে বা জমির মাঝখানে নলগাছ পোঁতা হয়। নল পোঁতার পর দুধ, চাল, কলা ও ফুল দিয়ে ভূমিদেবীর পূজা দেওয়া হয়। এটি কৃষকের প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের প্রতীক। বিশ্বায়নের যুগে এই প্রাচীন লোকাচারটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। বর্তমানে শহুরে উৎসবের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়, যার ফলে গ্রাম বাংলার এমন অনেক সমৃদ্ধ লোকাচার বর্তমানে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। 

নল সংক্রান্তি তাই শুধুমাত্র কৃষি-সংক্রান্ত প্রথা নয়, এটি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির এক জীবন্ত উত্তরাধিকার, যেখানে বিজ্ঞান, বিশ্বাস ও প্রাকৃতিক প্রজ্ঞা একসূত্রে গাঁথা।

Loading