October 5, 2025

একজন শিক্ষক, এক আন্দোলন – মাস্টারদা বরুণ বিশ্বাসের কথা আজও থেমে নেই

সোমালিয়া ওয়েব নিউজঃ আজ থেকে ১৩ বছর আগে, ২০১২ সালের ৫ জুলাই, শিক্ষক দিবসে এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গোবরডাঙা স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে থেমেছিল বনগাঁ আপ লোকাল। সেই ট্রেন থেকে নেমে মিত্র ইনস্টিটিউশনের বাংলার শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস হাঁটা ধরেন নিজের বাইকের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটে যায় সেই মর্মান্তিক ঘটনা—পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে দুটি গুলি, এক পিঠে, এক বুকে। ছটফট করতে করতে লুটিয়ে পড়েন মাস্টারদা। প্রায় আধঘণ্টা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থেকেও পাননি কোনও সহানুভূতির স্পর্শ। সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছানো গেলে প্রাণে বেঁচে যেতেন, বলছেন তাঁর ঘনিষ্ঠরা।

বরুণ বিশ্বাসের মৃত্যু শুধু একটি হত্যাকাণ্ড নয়, তা ছিল এক আদর্শের উপর আঘাত। এক শিক্ষক, যিনি একাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন এক গোটা অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে, যাঁর কণ্ঠে প্রথম শোনা গিয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা—তিনি আর নেই।

উত্তর চব্বিশ পরগণার সীমান্তবর্তী গ্রাম সুঁটিয়া। একসময় এই গ্রামের নাম উচ্চারিত হতো ভয় আর কলঙ্কের প্রতীক হিসেবে। ১৯৯০ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সময়কাল জুড়ে চলেছিল একের পর এক গণধর্ষণ, নারকীয় অত্যাচার। নারীদের উপর চলে যৌন নিপীড়নের নৃশংসতা, ক্যামেরাবন্দি করা হত সেই পাপ—আর তাতেই ব্ল্যাকমেল। এই অন্ধকারের মাথায় ছিল সুশান্ত চৌধুরী, বীরেশ্বর ঢালি প্রমুখ একদল রাজনৈতিক আশীর্বাদপুষ্ট দুষ্কৃতি।

ঠিক তখনই আবির্ভাব বরুণ বিশ্বাসের। বয়স তখন মাত্র ২৬-২৭। সদ্য চাকরি পেয়েছেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনে। কিন্তু শহরের আরামের জীবন বেছে না নিয়ে, ফিরে এসেছিলেন গ্রামে। এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন—
“আমরা যদি আমাদের মা-বোন-মেয়েদের সম্মান রক্ষা না করতে পারি, তাহলে আমরা অপরাধীদের থেকেও বড় অপরাধী।”

বরুণ বিশ্বাস গড়ে তোলেন ‘সুঁটিয়া ধর্ষণ বিরোধী মঞ্চ’। স্থানীয় তরুণদের নিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। দিনের পর দিন চিঠি লিখেছেন প্রশাসনের কাছে। ধর্ষিতা মেয়েদের সমাজে পুনর্বাসিত করেছেন, বিয়েও দিয়েছেন নিজ উদ্যোগে। সিআইডির তদন্তে অবশেষে ধরা পড়ে অপরাধীরা, হয় যাবজ্জীবন সাজা।

অপরাধীদের এক জনকে জেলে যাওয়ার সময় হাতে তুলে দিয়েছিলেন ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’। বলেছিলেন, “জেলে বসে পড়িস।” এই মানবিক মুখই বরুণ বিশ্বাস।

প্রতিবাদের গতি থেমে থাকেনি। বরুণ লক্ষ্য করেন, মাটি-মাফিয়ারা কেটে নিচ্ছে নদীর তীর, যার ফলে প্রতি বছর ভেসে যায় সুঁটিয়া। আবারও শুরু হয় আন্দোলন। উঠে আসে মাটি পাচারকারীদের চক্র। বরুণ বিশ্বাস হয়ে ওঠেন নতুন এক বিপদ—এবার এই নদী বাঁচাও আন্দোলনই তাঁকে মৃত্যু এনে দেয়।

২০১২ সালের সেই হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৬ সালে ধরা পড়ে পাঁচ খুনি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সুশান্ত চৌধুরীর নির্দেশেই খুন। কিন্তু কে দিয়েছিল নির্দেশ? কারা অর্থ জুগিয়েছিল? সিআইডির চার্জশিটে নেই তার উল্লেখ। এক রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এলেও তদন্ত হয়নি তাঁর বিরুদ্ধে।

বরুণের পরিবারের দাবি, বিচার এখনও অসম্পূর্ণ। মামলাটি এখনও চলছে বনগাঁ মহকুমা আদালতে।

বরুণ বিশ্বাস শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না—তিনি ছিলেন নেতা, সংগ্রামী, মানবিক। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বই, খাতা, পেন কিনে দিতেন। রাত জেগে বাইকে গ্রাম পাহারা দিতেন। তাঁর থাকার ঘরে ছিল একটি খাট, তাতেও ছিল না গদি—সারল্য ও সংগ্রামের জীবন্ত মূর্তি ছিলেন তিনি।

শেষ কথা নয়, শুরু…

বরুণ বিশ্বাস আজ নেই, কিন্তু তাঁর আদর্শ আজও অনেককে সাহস জোগায়। সুঁটিয়ার মানুষ আজও বলেন,
“মাস্টারদার মৃত্যু নেই।”

আজ শিক্ষক দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতেই হয়—

“ভালো থাকুন বরুণ বিশ্বাস। বিশ্বাস থাক। বিশ্বাস বাঁচুক।”

Loading