সোমালিয়া ওয়েব নিউজ; প্রতি বছর আশ্বিন মাসে (বা ক্বচিৎ কার্তিক মাসে) বাঙালি হিন্দুদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজার এক গুরুত্বপূর্ণ দিন হলো মহানবমী। মূলত এই দিনেই দেবী দুর্গার আরাধনার সমাপ্তি ঘটে। মহাষষ্ঠী থেকে শুরু হওয়া এই উৎসবের এই নবম তিথিটি শুধুমাত্র একটি দিন নয়, এটি অশুভ শক্তির উপর শুভশক্তির চূড়ান্ত বিজয়ের প্রতীক এবং বাঙালির সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক চেতনার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
মহানবমীর পৌরাণিক গুরুত্ব–
হিন্দু শাস্ত্র ও পুরাণে মহানবমীর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এটি সেই দিন, যখন দেবী দুর্গা মহিষাসুর নামক মহাবলশালী অসুরকে বধ করে দেবতাদের ও মর্ত্যবাসীকে তার অত্যাচার থেকে মুক্ত করেন বলে বিশ্বাস করা হয়।
- মহিষাসুরমর্দিনী রূপ: নবমীর দিনে দেবী দুর্গাকে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ রূপে পূজা করা হয়। জনশ্রুতি অনুযায়ী, নয় দিন ধরে চলা মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর ঘোরতর যুদ্ধের এই দিনেই অসুরটি সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত ও মারাত্মকভাবে আহত হয়। পরের দিন দশমীতে তার সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটে, যা ‘বিজয়া দশমী’ রূপে পালিত হয়। তাই নবমী তিথিটি অশুভের বিনাশের পথে চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত।
- দেবী সিদ্ধিদাত্রী: উত্তর ভারত ও অন্যান্য অঞ্চলে এই দিনটিকে নবরাত্রির নবম দিন হিসেবে দেবী সিদ্ধিদাত্রী-র আরাধনা করা হয়। তিনি দেবী দুর্গার নবম রূপ, যিনি ভক্তদের জ্ঞান, মোক্ষ এবং সকল প্রকার সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন।
- রামের বিজয়: অন্য একটি পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, শ্রী রামচন্দ্র এই নবমীর দিনেই দেবী দুর্গার আশীর্বাদ ও শক্তি লাভ করে রাবণকে বধের জন্য প্রস্তুত হন। এই কারণে এই পূজা ‘অকাল বোধন’ নামে পরিচিত, কারণ শাস্ত্র মতে দেবীর পূজার সময় বসন্তকাল, কিন্তু রাম অকালে শরৎকালে দেবীকে জাগরিত করেছিলেন।
আচারের মধ্য দিয়ে দেবীর আরাধনা
নবমীর দিনটি পূজার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানে মুখর থাকে। এই দিনের প্রধান কয়েকটি আচার নিচে দেওয়া হলো: - সন্ধিপূজা সমাপ্তি: মহাষ্টমীর শেষ ২৪ মিনিট এবং মহানবমীর প্রথম ২৪ মিনিট মিলিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের যে ‘সন্ধিপূজা’ অনুষ্ঠিত হয়, তার সমাপ্তি ঘটে নবমীর প্রারম্ভেই। এই সময় দেবী চামুণ্ডার পূজা করা হয় এবং দেবীর চরণে ১০৮টি পদ্মফুল ও প্রদীপ নিবেদন করার প্রথা প্রচলিত।
- মহানবমী বিহিত পূজা: এদিন সকালে মহানবমী কল্পারম্ভ-এর মাধ্যমে বিহিত পূজা শুরু হয়। দেবী দুর্গার কাছে ষোড়শ উপাচারে পূজা নিবেদন করা হয়।
- হোম ও যজ্ঞ: মহানবমীর একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আচার হলো যজ্ঞ (হোম)। ভক্তরা নিজেদের মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্য এই যজ্ঞে আহুতি প্রদান করেন। সাধারণত ১০৮টি বেলপাতা, আম কাঠ ও ঘি দিয়ে এই হোম অনুষ্ঠিত হয়, যা পূজার সম্পূর্ণতা নির্দেশ করে।
- কুমারী পূজা: অনেক অঞ্চলে মহাষ্টমী বা মহানবমীর দিনে ‘কুমারী পূজা’ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে কুমারী মেয়েদের দেবী দুর্গার জীবন্ত প্রতিরূপ হিসেবে পূজা করা হয়।
বিদায়ের সুর
যদিও মহানবমী বিজয়ের এক আনন্দময় বার্তা বহন করে, তবুও এই দিনটিতেই দুর্গাপূজার অন্তিম পর্যায় শুরু হয়। শাস্ত্র মতে, এই দিনেই পূজার মূলপর্ব শেষ হয়, কারণ পরের দিন অর্থাৎ বিজয়া দশমীতে কেবল দেবীর বিসর্জন পর্ব বাকি থাকে। তাই নবমীর রাতকে ‘নবমী নিশি’ বলা হয়, যখন উৎসবপ্রেমী বাঙালির মনে আনন্দের মাঝে এক বিষাদের সুরও বেজে ওঠে— কারণ মা আবার এক বছরের জন্য ফিরে যাচ্ছেন কৈলাসে।
মহানবমী তাই শক্তি, শুদ্ধতা ও বিজয়ের এক মহৎ সংমিশ্রণ, যা প্রত্যেক বাঙালিকে তার ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে। এটি শুধু একটি পূজা নয়, এটি অশুভের বিনাশে শুভের চিরন্তন জয়লাভের এক চিরন্তন উৎসব।

More Stories
দার্জিলিংয়ে প্রবল বৃষ্টি ও ধসে মৃত ১৩, নিখোঁজ ১
কালীঘাটে বিজয়া সম্মিলনীতে মমতা–অভিষেক
প্লাবনের আশঙ্কা ও প্রবল বৃষ্টির পূর্বাভাস: রাজ্য সরকারের সতর্কবার্তা