🕉️ তারকেশ্বর ধাম : বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও ইতিহাসে অনন্য এক তীর্থক্ষেত্র

সোমালিয়া ওয়েব নিউজ; হুগলির বুকে এক আধ্যাত্মিক অধ্যায় — তারকেশ্বর ধাম। শিবভক্তদের কাছে এটি শুধু একটি তীর্থ নয়, এটি ভক্তি, আস্থা ও চিরন্তন ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিদিন হাজার হাজার ভক্ত এখানে আসেন “বাবা তারকনাথ”-এর দর্শন পেতে, জল ঢালতে, মানত করতে। কিন্তু এই পবিত্র ভূমির ইতিহাস অনেকেরই অজানা। আজ আমরা তুলে ধরছি সেই অলৌকিক কাহিনি, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তারকেশ্বর ধামের গৌরবগাঁথা।

যেখানে আজ মহিমান্বিত মন্দিরটি দাঁড়িয়ে, একসময় তা ছিল জলা ভূমি ও শ্মশান। সেখানেই বাস করতেন এক সাধু — ধুম্রপানগিরী। তাঁর সান্নিধ্যে সেই স্থান পবিত্রতা লাভ করে। তারকেশ্বরের তৎকালীন রাজা ছিলেন ভার্মাল্য রাজা, যিনি বর্ধমান মহারাজার অধীনস্থ ছিলেন। রাজার এক গরু প্রতিদিন সেই শ্মশান ভূমিতে গিয়ে এক শিলাখণ্ডের উপর দুধ দিত। প্রথমে রাখাল বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তীকালে রাজাকে জানায়। রাজা কৌতূহলবশত সেই স্থান পরিদর্শন করেন এবং অলৌকিকভাবে আবিষ্কার করেন — শিলার নিচে একটি স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। রাজা চেয়েছিলেন সেই শিবলিঙ্গ নিজের আদি বাড়ি রামনগরে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তিনি লিঙ্গটি তুলতে পারেননি। তখন তিনি স্বপ্নাদেশ পান — “এই লিঙ্গ অনাদি, এখান থেকেই এর পুজো শুরু হোক”। সেই আদেশ অনুযায়ী রাজা সেই স্থানেই মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই প্রায় ৫০০ বছর আগে আগে সূচনা হয় তারকেশ্বর ধাম-এর।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, ধুম্রপানগিরীর একটি ঘোড়া ছিল। রাজা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন— যতদূর পর্যন্ত ঘোড়াটি দৌড়াবে, ততদূর পর্যন্ত ভূমি তারকনাথের নামে দান করবেন। এভাবেই ধামটির প্রাথমিক পরিসর গঠিত হয়। ধুম্রপানগিরীর পর তাঁর শিষ্য-পরম্পরায় একে একে বহু মহন্ত এই পবিত্র স্থানটির দায়িত্ব পালন করেন। একসময় ধামের শাসনভার আসে সতীশ গিরি মহারাজ-এর হাতে। তিনিই ছিলেন “তারকেশ্বর রাজবাড়ী”-র প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু পরবর্তীকালে কিছু অজানা কারণে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন, এই আন্দোলনের মাধ্যমে সতীশ গিরী মহারাজ কে পদচ্যুত করা হয়। যার নেতৃত্বে ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং বঙ্গদেশের আরো অনেকে। এর পর আদালতের নির্দেশে ধামের শাসনভার যায় দন্ডীস্বামী জগন্নাথাশ্রম মহারাজ-এর হাতে, যিনি প্রায় ১৫ বছর ধামের সেবা করেন। তাঁর পরবর্তী মহন্ত ছিলেন দন্ডীস্বামী ঋষিকেশাশ্রম মহারাজ, যিনি ৫৯ বছর ধরে এই আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে শ্রীমদ্ দন্ডীস্বামী সুরেশ্বরাশ্রম মহারাজ এই ধামের শাসনভার গ্রহণ করেছেন এবং সেই ঐতিহ্য আজও অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।

ঐতিহ্যযে রাজবাড়ীটি আজও ধামের গৌরব বহন করছে, সেটি নির্মাণ করেছিলেন সতীশ গিরি মহারাজ। এই রাজবাড়ী শুধুই প্রশাসনিক কার্যালয় নয়, এটি বাবা তারকনাথের মূল কার্যালয়। এখান থেকেই পরিচালিত হয় পুজো, ধর্মীয় আচার এবং ধাম সম্পর্কিত যাবতীয় কার্যকলাপ। রাজবাড়ীর স্থাপত্য ও ঐতিহ্য আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তারকেশ্বরের সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সনাতন ধর্মের বীজ এখান থেকেই সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে।

বর্তমান মোহন্ত মহারাজ শ্রীমদ্ দন্ডীস্বামী সুরেশ্বরাশ্রম বাবা জানান —“বর্তমানে যেভাবে শিবের আরাধনা করা হচ্ছে, তা শাস্ত্রসম্মত নয়। অনেকেই আচার-বিচার ভুলে বাহ্যিক আড়ম্বরকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। শিব আরাধনা মানে অন্তরের শান্তি ও ভক্তি। আজ সেই ভক্তির জায়গায় প্রতিযোগিতা চলে এসেছে। এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ” তিনি আরও বলেন —“যেভাবে ‘জল আনা’র রীতি ছিল, এখন তা বিকৃত হয়ে গিয়েছে। এই কদর্য ভাব থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। একমাত্র প্রাচীন সনাতন রীতিনীতির মাধ্যমেই শিবের আরাধনা করলে আমরা সত্যিকারের সুফল পাব।” রাজনীতি সম্পর্কেও তিনি স্পষ্ট বার্তা দেন —“ধর্মের পথে থাকতে হলে রাজনীতি করতেই পারেন, কিন্তু ধর্মকে বিসর্জন দিয়ে নয়। ধর্মকে সামনে রেখে, ধর্মের রীতিনীতি বজায় রেখে সততার পথে থেকে কাজ করলেই সমাজ সংস্কার সম্ভব হবে।”

এখানেই রয়েছে দুইটি পবিত্র মন্দির — আদি শংকরাচার্যের মন্দির এবং লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির।দুই মন্দিরেই প্রতিদিন ধর্মীয় আচার পালিত হয় এবং ভক্তদের উদ্দেশ্যে নিত্য ভোগ বিতরণ করা হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে ভক্তদের আগমন, ঘণ্টাধ্বনি ও শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে থাকে সমগ্র রাজবাড়ী প্রাঙ্গণ।

আজও তারকেশ্বর ধামের প্রতিটি ইট, প্রতিটি ঘণ্টাধ্বনি যেন শোনায় সেই প্রাচীন অলৌকিক ইতিহাসের গল্প। এটি শুধু একটি শিবমন্দির নয়, এটি বাংলার সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সাক্ষী। বাবা তারকনাথ যেন যুগে যুগে তাঁর ভক্তদের আশীর্বাদে পরিপূর্ণ রাখেন—এই কামনাতেই প্রতিটি ভক্তের প্রার্থনা ধ্বনিত হয় তারকেশ্বরের পবিত্র চত্বরে—🕉️ “বাবা তারকনাথ শম্ভো শরণং!” 🕉️