চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। জঙ্গলে গাছের মাথায় মিটমিট করে জোনাক জ্বলছে ।সারা দিন মনিবের বাড়িতে পরিশ্রম করে ফিরে এসে স্বামী আমার একটা চ্যাটাই পেতে ক্লান্ত হয়ে উঠোনে শুয়ে আছে। একটু পরেই রাতের খাওয়া-দাওয়া হবে। দাওয়ায় বসে লন্ঠনের আলোয় ছেলেটাকে সহজ পাঠ বইটা পড়াচ্ছি।
আমার বাপের বাড়িতে লেখাপড়ার খুব কদর ছিল। তাই আমিও একটু শিখে ছিলাম মা। স্বামী আমার একেবারে নিরক্ষর ।তবে খুবই কর্মঠ এবং সহজ সরল মানুষ। আর মানুষটার সরলতার জন্যেই ওর হাতে বাবা আমাকে তুলে দিয়েছিল ।মিথ্যা বলব না মানুষটা সংসারে মোটা ভাত কাপড়ের অভাব রাখেনি। ছেলেটাকে নিয়ে ওর কত স্বপ্ন ছিল। বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে পাঁচ জনের একজন হবে। মানুষের উপকারে লাগবে।
ছেলেটার বয়স এখন সাত বছর। খুব বাপ ন্যাওটা।
আরো একটু আর্থিক স্বাচ্ছ্যন্দের কথা ভেবে মানুষটাকে আমি অনেকবার বলেছি, আমিও কোন বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করি। ও রাজি হয়নি ।লোকের বাড়িতে কাজ করতে যাব বলতেই সেদিন আমাকে বলেছিল, এখন নয় আমি মরে গেলে তখন—
সেই কথাটা যে এমনি সত্যি হয়ে যাবে কোনদিন স্বপ্নেও ভাবি নি মা। তোমার কাছে একটা কাজের জন্য এসে শুধুই মানুষটার কথাগুলো মনে পড়ছে।
প্রথম প্রথম অনেক কেঁদেছি ছেলেটার কথা ভেবে। এখন নিজেকে পাথর করে নিয়েছি। বাপের বাড়িতে আমার মা বাবা কেউ নাই। মা অনেক আগেই কঠিন অসুখে ভোগে মারা গেছে। মায়ের শোকে বাবাও দু’বছর আগে ভব লীলা সাঙ্গ করে চলে গেছে। ভাইয়ের সংসারে কেন বোঝা হয়ে থাকবো মা!
ছেলেটাকে বড় করে তুলতে হবে,এখন তো আমিই ওর মা আমিই ওর বাবা।
ছেলেটা তখন দুলে দুলে পড়ছে, বনে থাকে বাঘ—-
হঠাৎ দশ-বারোজন ষন্ডামার্কা লোক এসে উঠোনে দাঁড়ালো। সবার হাতে লাঠিসোটা দেখে কেমন যেন ভূত দেখার মত হয়ে যাই।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন সজোরে একটা লাথি মারতে আধঘুমন্ত মানুষটা ধরফড়িয়ে উঠে বসে। ছেলেটা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ওদের মধ্যে থেকে একজন আমার স্বামীর মাথার চুলটা খামচে ধরে বলে, এ্যাই শালা বল, সেদিন বকুলতলার মাঠে ওদের পার্টির মিটিং এ গেসলি ক্যানে?
তুমি বিশ্বাস করো মা, আমরা জীবনে কোনদিন কোন পার্টির মিটিং মিছিলে যাইনি। সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে সময় কোথায় মিটিং মিছিলে যাবার? তবে হ্যাঁ সেদিন যখন আমার স্বামী কাজ সেরে ফিরছিল তখন বকুলতলার খেলার মাঠ টাতে তখন একজন সিনেমা আর্টিস্ট মঞ্চে উঠে কি সব বলছিল, তাকে দেখার জন্য কিছুক্ষণ মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল।সেটা কি খুব দোষের মা?
তাই লোকটার জিজ্ঞাসার উত্তরে আমার স্বামী যখন বলে, আমি মিটিংয়ে নয় শুধু—
কে শোনে কার কথা। সবার মুখে মদের গন্ধ, সবার মুখে অশ্রাব্য ভাষা। ওরা সবাই মিলে আমার চোখের সামনে মানুষটাকে সাপমারার মতো মারছে । মাটিতে পড়ে ও চিৎকার করছে। আমি ছুটে যায় বাধা দেবার জন্য। ওদের দুজন আমাকে জাপটে ধরে।
মারের চোটে মানুষটা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে উঠোনের মাটি ।আমার উনুনটার পাশেই রাখা ছিল কেরোসিনের জারটা। সেই জারটা তুলে নিয়ে এসে কেরোসিন তেলটা ওর সারা গায়ে ছিটিয়ে দিলো মারের চোটে আধমরা মানুষটার গায়ে। তারপর একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে আগুন লাগিয়ে দিলো। উঃ সে কি বীভৎস কি পৈশাচিক দৃশ্য।
আমি চিৎকার করে সবাইকে ঠেলে সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আমার চুলের মুঠি ধরে ওরা কয়েকজন আমাকে সেই আগুন থেকে টেনে বের করে আমার গায়ে জল ঢেলে দিল।সারাগায়ে বড় বড় ফোস্কা। জলন্ত অগ্নিকুন্ডে করছে আমার স্বামী। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছি আমি। আমার মুখটা চেপে ধরে ওরা আমাকে চ্যাংদোলা করে ঘরের ভিতরে ঢোকালো। তারপর পাশবিক আক্রোশে আমার শরীরটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলো।
অসহ্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া রক্তাক্ত দেহটা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে ঢেকে যখন উঠোনে নামলাম, তখন আমার স্বামীর দেহটা পুড়ে একেবারে কয়লা হয়ে গেছে । আমি হাহাকার করে কাঁদছি, ছেলেটার চোখে জল নাই ।তার পাথর হয়ে যায় চোখ দুটো থেকে যেন ঠিকরে বের হচ্ছে আগুনের গোলা, মনে হচ্ছে যেন সেই আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যাবে সারা ব্রহ্মাণ্ড।
আমি ওকে কাঁপা কাঁপা হাতে আমার বুকে জড়িয়ে ধরলাম।
যাবার সময় লোক গুলো শাসিয়ে গেল।
যদি আমি পুলিশের কাছে যাই তাহলে ওরা আমার ছেলেকেও ওর বাবার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে। ওদের ভয়ে প্রতিবেশীরাও কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। পাড়ার বয়স্ক একজনকে কাকা বলতাম। সেই কাকা একদিন লুকিয়ে আমার ঘরে এলো। তার পা দুটো জড়িয়ে ধরে আমি কাঁদতে লাগলাম। কাকারও দুচোখে জল।
সেই কাকাই বলল, -ছেলেটাকে নিয়ে তোর আর এখানে থাকা নিরাপদ নয় ।
ছেলের মুখ চেয়ে সেদিন আমি লুকিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এসে এখানে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নিই। ওরাই চিকিৎসা করিয়ে আমার শরীরের পোড়া ঘা গুলো সারিয়েছে ।ঘা গুলো সেরেছে কিন্তু পোড়া দাগ গুলো রয়ে গেছে।
দেখো মা দেখো, বুকের মাঝে এই পোড়া দাগটা ঠিক যেন ভারতবর্ষের মানচিত্র।
More Stories
হরিচরণ
আজ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন
আজ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে