সোমালিয়া সংবাদ, আরামবাগ: লোকসভা নির্বাচনে আরামবাগ কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী অরূপকান্তি দিগারকে ৬৩৯৯ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী মিতালি বাগ। ২০১৯ সালে এই জয়ের ব্যবধান ছিল ১১৪২ ভোট। সেবার বিজেপি প্রার্থী তপন রায় তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা পোদ্দারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তারপর জেলা সভাপতি বিমান ঘোষের নেতৃত্বে বিধানসভা নির্বাচনে আরামবাগ মহকুমার চারটি আসনেই জয়ী হন বিজেপি প্রার্থীরা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে খানাকুলে বিজেপি আশাতীতভাবে ভাল ফল করে একটি পঞ্চায়েত সমিতি এবং বেশ কিছু পঞ্চায়েত দখল করে নেয়। এমনকি পুরশুড়াতেও মোটামুটি ভালই ফল করে বিজেপি। তাই ওপিনিয়ন পোল এবং পরবর্তীকালে বুথ ফেরত সমীক্ষাতেও জানানো হয়েছিল আরামবাগ লোকসভা আসনটি এবার বিজেপি নিশ্চিতভাবেই পেতে চলেছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হতেই দেখা গেল অল্প কয়েক হাজারের ব্যবধানে তৃণমূল প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। এরপরেই বিজেপির এই পরাজয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্নভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।
কেউ কেউ বিজেপি জেলা নেতৃত্বের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। কেউ কেউ ড্যামি প্রার্থী নির্বাচনকে দায়ী করছেন। কিন্তু ২০১৯ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা এটা অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে সারা দেশজুড়ে একটা মোদি-হাওয়া ছিল। দশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর মোদির সেই জনমোহিনী ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। নাহলে আরামবাগের মতো সম্ভাবনাময় আসনে প্রধানমন্ত্রীর স্বয়ং দু’বার প্রচার সত্ত্বেও পরাজয় হতো না। এছাড়াও এই কেন্দ্রে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার থেকে শুরু করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক, অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষেরাও প্রচার করে গেছেন। তারপরেও এই পরাজয় শুধু দলের নেতাকর্মীদেরকেই নয়, রাজনৈতিক মহলেও বিস্ময় তৈরি করেছে। কিন্তু অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন, ২০১৯ সালে এনআরসি বা সিএএ জুজু ছিল না। ফলে সংখ্যালঘু ভোটে তার কোন প্রভাব পড়ার প্রশ্ন ছিল না। বিজেপি ওই সংখ্যালঘু ভোট না পেলেও তৃণমূল ওই ভোটকে এবারের মতো এতটা ঐক্যবদ্ধ করতে পারেনি। এছাড়াও তখন লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প ছিল না। এই প্রকল্প যে মহিলাদের একটা বড় অংশের ওপর প্রভাব ফেলেছে এ নিয়ে কোন প্রশ্নই নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে এই দুই বিরুদ্ধ শক্তির বিরুদ্ধে বিজেপিকে লড়াই করতে হয়নি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে এনআরসি এবং সিএএকে সামনে রেখে প্রচার চালিয়েছিল তৃণমূল। ফলে তারা সংখ্যালঘু ভোটকে আরও অনেক বেশি করে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। পাশাপাশি লক্ষ্মীর ভান্ডার পাওয়া মহিলাদের একটা বড় অংশের ভোটও গেছে তৃণমূলের পক্ষে। এরপরেও বিজেপি যে জয়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছে সেটাও কিন্তু কম কথা নয়। তার ওপর বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পরেও বিজেপি বিধায়কদের এলাকায় তেমনভাবে দেখা যায়নি। বিশেষ করে আরামবাগ ও গোঘাটের মানুষ তাদের বিধায়ককে নিজেদের প্রয়োজনে কাছে পাননি। তা সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা সামাজিক অনুষ্ঠানই হোক। অথচ বিধানসভা নির্বাচনে হারার পরেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই সাধারণ মানুষের ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে বিজেপির ওপর তাদের ভরসার জায়গাটা তেমন ভাবে তৈরি হয়নি। যেখানে যেখানে বিজেপি বিধায়করা মাঠে নেমে কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই পুরশুড়া এবং খানাকুলে বিজেপির ফল অনেকটাই ভাল। এমনকি দলের জেলা সভাপতি বিমান ঘোষ বিভিন্ন সময়ে নিজের বাড়ির এলাকা গোঘাট- ১ নম্বর ব্লকে কর্মসূচি করেছিলেন। তার ফলও হাতেনাতে পাওয়া গেছে। এই ব্লক থেকে বিজেপি বড়সড় লিড পেয়েছে অর্থাৎ যেখানে কর্মী-সমর্থকরা বিধায়ক বা তাদের দলের কার্যকর্তাদের কাছে পেয়েছে সেখানে কিন্তু বিজেপির ফল খুব একটা খারাপ হয়নি। বরং সারা রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় যেভাবে বিজেপির ভরাডুবি ঘটেছে সেই ভরাডুবির অনেকটাই প্রতিরোধ করতে পেরেছে জেলা সভাপতি বিমান ঘোষের নেতৃত্বাধীন সাংগঠনিক দক্ষতা। তৃণমূলের হাতে যেখানে এনআরসি, সিএএ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো তুরুপের তাস ছিল বিজেপির তাস একমাত্র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনসভা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর জনমোহিনী ক্ষমতায় ভাটা পড়ে যাওয়ায় বিজেপিকে আরামবাগ আসনটি হারাতে হয়েছে। যদিও এর মাঝেও একটা বড় ঘটনা ঘটে গেছে। সেটি হল ধর্মীয় মেরুকরণ। বিভিন্ন বুথভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে তৃণমূলের জয়ের প্রধান কারিগর সংখ্যালঘুরা। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বুথগুলিতে বড় ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই জয়ী হতে পেরেছে তৃণমূল। নাহলে সংখ্যাগুরু অধ্যুষিত বুথগুলির বেশিরভাগেই জয়ী হয়েছেন বিজেপি প্রার্থী। অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি সংখ্যাগুরুদের মধ্যেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত দু’বছর ধরে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটানা প্রচার এক্ষেত্রে টনিকের মতো কাজ করে থাকতে পারে। আগামী দু’বছর সেই প্রবণতা যদি বাড়তে থাকে তাহলে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তা তৃণমূলের ক্ষেত্রে কিন্তু খুবই আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে সারা রাজ্যের পাশাপাশি আরামবাগ লোকসভার অন্তর্গত বেশ কয়েকটি বিধানসভা আসনেও চমকে দেওয়ার মতো ফল করতে পারে বিজেপি। এবারের নির্বাচনে যেন তারই ইঙ্গিত মিলছে।
More Stories
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির গোঘাট এক নম্বর আঞ্চলিক কমিটির তৃতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত
গোঘাটে দুর্গোৎসবের মূল আকর্ষণ ‘রাবণ কাটা’ রথের মেলা
রামকৃষ্ণ সেতু ২৪x৫ ঘন্টা খোলা রাখার আবেদন মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া পর্যন্ত — দুর্গাপুজোয় নির্বিঘ্ন যাতায়াতের স্বার্থে বিধায়ক মধুসূদন বাগের মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি