October 5, 2025

খাটুলের চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোতে ৩১৩ বছরের ঐতিহ্য

সোমালিয়া ওয়েব নিউজ: হুগলি জেলার গোঘাটের খাটুলে গ্রামে এখন উৎসবের আমেজ। ভাদ্রের প্রখর গরম যেন মুছে গেছে ঢাকের বাদ্যি আর ধূপের গন্ধে। কারণ, চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো এই বছর পদার্পণ করেছে গৌরবময় **৩১৩ বছরে**।

স্থানীয়রা বলেন, এটি শুধু একটি পুজো নয়, বরং গোটা অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আস্থার সঙ্গে মিশে থাকা এক ঐতিহ্যের প্রতীক। আজও পুজোর দিনগুলিতে খাটুলে যেন এক মায়াবী আবহে আবৃত হয়ে ওঠে।

 স্বপ্নাদেশ থেকে শুরু বনেদি পুজোর পথচলা–

চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোর সূচনা ঘিরে রয়েছে অলৌকিক কাহিনি। কথিত আছে, প্রাচীনকালে খাটুলে দিঘির পাড়ে বহুকাল আগে দুর্গা মন্দিরটি ছিল, তখন দেবী দুর্গা গ্রামে সার্বজনীনভাবে পূজিত হতেন। বেশ কয়েক বছর পর তৎকালীন সময়ে পুজো কর্মকর্তাদের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয় এবং পুজো বন্ধ থাকবে এই রকমই সিদ্ধান্ত হয়। তখন চৌধুরী পরিবারের রামতনু রত্নালংকারকে মা দুর্গা স্বপ্নাদেশ দেন পুজো চালু করার জন্য। দারিদ্র্যসঙ্কুল সংসারে তিনি দ্বিধাগ্রস্ত হলেও দেবী নির্দেশ দেন, “যা আছে তাই দাও, আমি সন্তুষ্ট হব।” মায়ের নির্দেশেই আজও এই পূজোর ভোগে বড়ি পোস্ত, শাকঘন্ট ও বিউলির ডালই প্রধান। মূর্তি গড়ার জন্যও দেবী স্বপ্নাদেশ দেন এক মৃৎশিল্পীকে, যিনি এক সকালে এসে হাজির হন চৌধুরী বাড়িতে। ঢাক বাজানোর জন্য ঢাকিও পান স্বপ্নাদেশ।

এই পুজো আজও চলে **সম্পূর্ণ বৈষ্ণব মতে**—এখানে কোনও জীব বলি হয় না। মহালয়ার পরদিন প্রতিপাদে ঘট বসানোর মাধ্যমে শুরু হয় আচারপর্ব।

বনেদি ঐতিহ্যের সাক্ষী, প্রথমে খড়ের চালের মন্দিরে পুজো হত। পরে মুক্তারাম চৌধুরী, যিনি ছিলেন এক বিরল প্রতিভাধর হস্তবিশারদ ও হাইকোর্টের নকল নবীশ, তিনি দলিল হুবাহু নকল করে লিখতে পারতেন, এমনকি দুই হাতে এবং দুই পায়ে তিনি লিখতে পারতেন। মুক্তারাম চৌধুরী নিজের উদ্যোগে বর্তমান মন্দিরটি তৈরি করেন।

দেবীর নামে প্রায় দু’এক বিঘা জমি রয়েছে, সেখান থেকেই পুজোর সমস্ত খরচ বহন হয়।

চৌধুরী পরিবার আজও এলাকার বনেদি পরিবার হিসাবে পরিচিত। তাঁদের সন্তানরা কেউ অধ্যাপক, কেউ আইনজীবী, কেউ বা অন্যান্য সম্মানজনক পেশায় যুক্ত। তবুও পুজোর সময় সবাই ফিরে আসেন গ্রামের আঙিনায়, মায়ের চরণে প্রণাম জানাতে।

 গ্রামজুড়ে উৎসবের আবহ, স্থানীয়রা মনে করেন, এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রত। তাই দূরদূরান্ত থেকেও মানুষ আসেন খাটুলের চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে ও প্রণাম জানাতে। পুজোপ্রাঙ্গণের পাশেই রয়েছে জাগ্রত জোড়া শিবমন্দির। তার সামনেই “শিবগেরে” নামে একটি পুকুর, যেখান থেকে বহু প্রাচীন শিবমূর্তি উদ্ধার হয়েছিল। কাছেই রয়েছে শতবর্ষপ্রাচীন বেলগাছ, যেখানে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় বেলবরণ পূজা।

 আস্থা, ঐতিহ্য আর আবেগের মিলন খাটুলের এই দুর্গাপুজো শুধু এক বনেদি পরিবারের আচার নয়—এটি গ্রামবাসীর বিশ্বাস, ঐতিহ্য আর আবেগের কেন্দ্র। ঢাকের আওয়াজে, শাঁখের ধ্বনিতে, কাশফুলের দোলায় আজও খাটুলে সাক্ষী থাকে মায়ের আহ্বান আর গ্রাম বাংলার অনন্ত ভক্তির।

Loading