সোমালিয়া ওয়েব নিউজঃ হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত বদনগঞ্জ গ্রামে প্রায় তিন শতাব্দী আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক অনন্য স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন—বদনগঞ্জ বিষ্ণুমন্দির। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির স্থাপত্যের আদলে নির্মিত এই প্রাচীন মন্দির আজ ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। উপযুক্ত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যেতে বসেছে।
১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে স্থানীয় জমিদার শ্রীরামসদয় বরাট এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর দুই পুত্র—বনবিহারী বরাট ও গোষ্ঠবিহারী বরাট নিঃসন্তান ছিলেন। ফলে পরবর্তীকালে গোষ্ঠবিহারীর স্ত্রীর ভাইপো নবগোপাল দাস মন্দির পরিচালনার দায়িত্ব পান। নবগোপালের দুই পুত্র—তাপস দাস ও মানস দাস বর্তমানে মন্দিরের দেখভাল করে চলেছেন। তবে মন্দিরের নিজস্ব সম্পত্তি না থাকায় এর সংরক্ষণ আজ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
মন্দিরটির উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট। বাংলার নবজাগরণের পূর্ববর্তী স্থাপত্যশৈলীর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি।
- মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা দ্বারা নির্মিত অসংখ্য প্রতিমূর্তি আজও টিকে আছে।
- রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি খোদাই করা আছে প্রাচীরজুড়ে।
- শ্রীকৃষ্ণের জন্ম, রাম-রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতের নানা যুদ্ধদৃশ্য, নৌকাবিহার, পশুপাখি, সামাজিক জীবনের চিত্র—সবই টেরাকোটা শিল্পে অঙ্কিত হয়েছে।
- মন্দিরের সামনের দিকে দশাবতারের মূর্তির টেরাকোটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যদিও বর্তমানে ভাঙনের মুখে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই মন্দির স্থানীয় গ্রামীণ জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল।
- বৈশাখ মাসে তিনবার পূজা ছাড়াও সারা বছরে আরও দুবার পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
- জন্মাষ্টমী, রাধাঅষ্টমী ও উত্থান একাদশী এখানে পালন করা হয়।
- একসময় এই মন্দিরে রাস উৎসব অনুষ্ঠিত হত, যা আশেপাশের গ্রামগুলোতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক মিলনমেলা সৃষ্টি করত। যদিও আজ সেই উৎসব বন্ধ হয়ে গেছে।
- পুরোনো রাসের মূর্তিগুলি এখনও সংরক্ষিত আছে।
আজ এই প্রাচীন মন্দির প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে। টেরাকোটা খোদাই ক্ষয়ে গেছে,ইটের দেওয়াল ফেটে গেছে,ছাদও গম্বুজে বড় ফাটল ধরেছে,মন্দিরের সামনে পড়ে থাকা দেবদেবীর কিছু প্রতিমা ভাঙা অবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয়রা বহুবার প্রশাসনের কাছে সংস্কারের দাবি তুললেও তাতে খুব একটা সাড়া মেলেনি। গবেষক ও ঐতিহাসিকরা ইতিমধ্যেই মন্দিরটির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশ থেকে আগত গবেষকরা এই মন্দির পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু সরকারি উদ্যোগের অভাবে বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকীর্তি হারানোর পথে।
বদনগঞ্জের বিষ্ণুমন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি বাংলার স্থাপত্য, টেরাকোটা শিল্প ও গ্রামীণ সমাজজীবনের ইতিহাস বহন করে চলেছে। আনুমানিক ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ নির্মিত এর বর্তমান কাঠামো আজ ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে। যদি অবিলম্বে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করা হয়, তবে বাংলার একটি অমূল্য ঐতিহ্য আমাদের চোখের সামনে থেকেই হারিয়ে যাবে।



![]()

More Stories
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের লড়াই আজও প্রাসঙ্গিক — আরামবাগের সিপিআইএমের নেতা সমীর চক্রবর্তীর অভিজ্ঞতায় উঠে এল সংগঠনের বাস্তবতা
আধুনিক প্রযুক্তির যুগে পড়ুয়া সংকটে গোঘাটের লাইব্রেরিগুলি – পাঠক টানতে উদ্যোগের খোঁজে গ্রন্থাগারগুলি
কোলাহলের মাঝেই চলছে অখণ্ড হরিনাম— হুগলির বদনগঞ্জের কয়াপাট বাজারের মন্দিরে ৪৬ বছরের ঐতিহ্য